সাহাদাত হোসেন পরশ :
আতিয়া জাহান মিথিলা (২৩)। রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। পরিবারের সদস্যদের কাছে তিনি ছিলেন খুব আদরের। বিড়ালপ্রেমী মিথিলা যেমন ভালো ছবি আঁকতেন, গাইতেনও দারুণ। যে বাসায় থাকতেন, সেখানে তাঁর ছিল সাতটি বিড়াল। ১১ অক্টোবর মোহাম্মদপুরের সাতমসজিদ রোডের ৯ নম্বর বাসায় তাঁর নিথর দেহ পড়ে থাকে। এর পর তাঁর বন্ধু মোস্তাক শাহরিয়া রাফি ও সজীব ক্যাফ্রি নামে আরেকজন তাঁকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। বন্ধুদের ভাষ্য, তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক শামীম হোসেন মরদেহের সুরতহাল তৈরি করেন।
প্রতিবেদনে তিনি লেখেন, গলায় দাগ রয়েছে। তবে ময়নাতদন্ত করার সময় চিকিৎসক তাঁর গলায় কোনো ধরনের আঘাতের চিহ্ন পাননি। এ কারণে চিকিৎসক সুরতহাল তৈরি করা পুলিশ কর্মকর্তাকে ফোন করে তাঁর সংশয়ের বিষয়টি জানান। বন্ধুদের কথা শুনে শুরুতে মিথিলার পরিবারের সদস্যরা ধারণা করেছিলেন, মিথিলা আত্মহত্যা করেছেন। চিকিৎসকের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ ও যে বাসায় থাকতেন সেখানকার আলামত দেখে পরিবার বলছে, তদন্ত করেই প্রকৃত ঘটনা বের করা হোক। পরিকল্পিত হত্যা বা আত্মহত্যার দিকে তাঁকে ঠেলে দেওয়া হলে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি তাদের। স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে মিথিলা ও রাফি বছরখানেক মোহাম্মদপুরের ওই বাসায় থাকলেও স্বজন তা জানতেন না। রাফি ইউল্যাবের ছাত্র। মিথিলা ও রাফি দু’জনের গ্রামের বাড়ি ঠাকুরগাঁও সদরে।
সুরতহাল প্রস্তুতকারক উপপরিদর্শক শামীম হোসেন সমকালকে বলেন, চিকিৎসক আমাকে ফোন করে জানতে চেয়েছেন, কেন সুরতহাল প্রতিবেদনে গলায় দাগের কথা লিখেছি। চিকিৎসক নাকি কোনো দাগ পাননি। আমি চিকিৎসককে জানিয়েছি, মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে ময়নাতদন্তের আবেদন করা হয়েছে। যখন সুরতহাল করেছি, তখন দাগ আমি পেয়েছিলাম। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
ধর্ষণ বা দলবদ্ধ ধর্ষণের আলামত রয়েছে কিনা– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বলা যাবে।
মিথিলার বাবা খন্দকার আনোয়ার হোসেন মিলন ঠাকুরগাঁওয়ে কাঁচামালের ব্যবসায়ী। দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। মেয়েকে ঘিরে বাবার অনেক বড় স্বপ্ন ছিল। আনোয়ার জানান, ১১ অক্টোবর রাত ৮টার দিকে মেয়ের সঙ্গে তাঁর সর্বশেষ কথা হয়। প্রতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে মেয়ের বাসা ভাড়ার টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঠান। ওই দিনও টাকা পাঠিয়ে মেয়েকে ফোন করেন।
তিনি বলেন, আমার মেয়ে আত্মহত্যা করতে পারে– এটা বিশ্বাস হয় না। সে অত্যন্ত সাহসী। বড় কিছু হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। রাজনৈতিক মামলায় যখন জেলে ছিলাম, তখনও মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে আসছি। পরিবারের সদস্যরা সহযোগিতা করেছে।
মিথিলার সঙ্গে বাবার মতো সম্পর্ক ছিল তাঁর চাচা খন্দকার আফতাব হোসেন স্বপনের। চাচাকে আব্বু বলে ডাকতেন তিনি। ভাতিজির কুকুর পোষার খরচের বড় অংশ তিনিই দিতেন। স্বপন বলেন, আমাদের বংশের বড় মেয়ে ছিল মিথিলা। কয়েক দিন আগেও দেখা করে ওকে টাকা দিয়ে আসি। একবার বন্ধুদের সঙ্গে কক্সবাজার ঘুরতে যাবে। বাবাকে বলতে ভয় পাচ্ছিল। এর পর আমার কাছে খরচ দেওয়ার আবদার করে। সেটা আমি দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, প্রথমে নানাজনের কথা শুনে মিথিলা আত্মহত্যা করেছে– এটা বিশ্বাস করেছিলাম। কাটাছেঁড়া ছাড়া ময়নাতদন্ত না করেই লাশ পেতে আবেদনও করি। পরে ধীরে ধীরে সন্দেহজনক কিছু তথ্য সামনে আসে। ডাক্তারই বলেছেন, আত্মহত্যার মতো কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। মোহাম্মদপুরের বাসায় গিয়ে দেখলাম যে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহননের কথা বন্ধুরা বলছে, সেখানে আত্মহত্যা করা অসম্ভব। রাফিকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের নথিপত্র বলছে, তিনজন মিথিলার লাশ হাসপাতালে নিয়ে যায়। রাফি ছাড়া অপর দুজন হলেন– সজীব ক্যাফ্রি ও মিনহাজ উদ্দিন।
সজীব জানান, চলতি বছরের শুরুর দিকে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেখে মোহাম্মদপুরের সাতমসজিদ রোডের এক বিল্ডিংয়ের সপ্তম তলায় দুই রুমের ফ্ল্যাটের একটি কক্ষ রাফির কাছ থেকে ভাড়া নেন তিনি। আগে থেকেই পাশের রুমে কয়েকজনকে নিয়ে থাকতেন রাফি। কিছুদিন পর তাঁর কক্ষে বান্ধবী মিথিলা এসে ওঠেন। এর পর বাকিরা চলে যান।
তিনি আরও বলেন, পাশাপাশি রুমে বসবাস করার কারণে ধীরে ধীরে রাফি ও মিথিলার সঙ্গে আমার এক ধরনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিছুদিন আগে রাফির সঙ্গে ঝগড়া করে ফুলের টব ভাঙচুর করেন মিথিলা। তখন একটি টব গিয়ে পোষা বিড়ালের ওপর পড়লে বিড়ালটি মারা যায়। ওই ঘটনা তাঁকে খুব আহত করেছিল।
ঘটনার দিনের বর্ণনা দিয়ে সজীব বলেন, ঘটনার দিন ভোরে মিথিলা ও রাফির মধ্যে ঝগড়ার শব্দ পেলাম। রাফি দুই রুমের মাঝের জায়গায় বসে আছে। এর পর হঠাৎ মিথিলা আমার রুমে আসে। তখন ভাবলাম রাগ করে নিজেদের রুম ছেড়ে আমার এখানে এসেছে। কিছু সময় পর রুমের ভেতর থেকে শব্দ পেলাম। এর পর রাফি দরজা ভেঙে দেখে সে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে। তবে মিথিলার চেহারা স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। পালস চেক করার মেশিন আনতে রাফিকে নিচে ফার্মেসিতে পাঠালাম। এত ভোরে ফার্মেসি খোলা না পেয়ে সে বাসায় ফিরে আসে। এর পর মিথিলাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, কী নিয়ে রাফির সঙ্গে দ্বন্দ্ব, এটা কখনও প্রকাশ করেননি মিথিলা। তবে মাঝে মাঝে দেখতাম তাদের মনোমালিন্য। মিথিলার মৃত্যুর পর তাঁর বিড়ালগুলো প্রতিবেশী দেখভাল করছে।
এ ব্যাপারে রাফির মোবাইলে একাধিকবার ফোন করলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। ঘটনার পর হাসপাতালে উপস্থিত মিনহাজ উদ্দিন জানান, মিথিলা ও তিনি একই কলেজে পড়তেন। খবর পেয়ে তিনি আসেন। এর বেশি তাঁর জানা নেই।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-